পদ্মা রেল লিংক প্রকল্প: বাংলাদেশের স্বপ্ন নাকি ভবিষ্যতের বোঝা?
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসেবে পরিচিত। এর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তবে, পদ্মা সেতুকে ঘিরে যে আলোচনার ঝড় বইছে, তার তুলনায় পদ্মা রেল লিংক প্রকল্প নিয়ে আলোচনা নগণ্য। অথচ প্রকল্পটির আর্থিক ব্যয় পদ্মা সেতুর তুলনায় বেশি এবং এর ভবিষ্যৎ প্রভাব দেশজুড়ে ব্যাপক।
পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯,২৪৬ কোটি টাকা, যেখানে পদ্মা সেতুর ব্যয় ছিল ৩০,১৯৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে কাজ শুরু হওয়া এই প্রকল্পটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা, যশোর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, এমনকি নারায়ণগঞ্জকে সরাসরি ঢাকার সাথে যুক্ত করবে। পুরো প্রকল্পটি চালু হলে খুলনা থেকে ঢাকা যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩.৫ ঘণ্টা। এছাড়া, বরিশাল বিভাগের সাথেও রেলপথের সংযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
কিন্তু এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং সমালোচনা এর সিঙ্গেল লাইনের নির্মাণ।
সিঙ্গেল লাইনে নির্মাণ: প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত
এত বড় একটি প্রকল্পে সিঙ্গেল লাইনে রেলপথ নির্মাণ কেবল অসাধারণ নয়, রীতিমতো সমস্যাজনক। পৃথিবীর কোথাও এত ব্যয়ে সিঙ্গেল লাইন নির্মাণের উদাহরণ খুবই কম।
উদাহরণস্বরূপ:
ইন্দোনেশিয়ার ২০২৩ সালে চালু হওয়া ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ উচ্চগতির রেলপথে খরচ হয়েছে ৭ বিলিয়ন ডলার। এই রেলপথে ট্রেন চলবে সর্বোচ্চ ৩৯০ কিমি/ঘণ্টা গতিতে। ইন্দোনেশিয়ার রেলপথে চীনের প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা ছিল।
বাংলাদেশের ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পে খরচ হয়েছে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এটি সিঙ্গেল লাইনে নির্মাণ করা হয়েছে এবং ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি হবে মাত্র ১২০ কিমি/ঘণ্টা। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, কেন এত ব্যয়ে সিঙ্গেল লাইন নির্মাণ করা হলো, যেখানে ডাবল লাইন সুবিধা দেশের জন্য অনেক বেশি কার্যকর হতো?
সিঙ্গেল লাইনের সীমাবদ্ধতা
সিঙ্গেল লাইনে ট্রেন চলাচলের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হয়:
- ট্রেন চলাচলের সীমাবদ্ধতা: সিঙ্গেল লাইনে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৩০টি ট্রেন চালানো সম্ভব। এর বেশি ট্রেন চালাতে গেলে ক্রসিং সমস্যাসহ সময়সূচির বিপর্যয় ঘটে।
- দুর্ঘটনার ঝুঁকি: সিঙ্গেল লাইনে ট্রেন চলাচলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে পুরো রেলপথ বন্ধ হয়ে যায়। এতে রেলপথের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।
- পরিবহন ক্ষমতা: দেশের চাহিদার তুলনায় সিঙ্গেল লাইনের সক্ষমতা অনেক কম। ফলে ভবিষ্যতে এটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
- সময়সূচি জটিলতা: সঠিক সময়সূচি মেনে ট্রেন পরিচালনা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
একই সিঙ্গেল লাইনে যদি ভারত ট্রানজিট সুবিধা নিয়ে তাদের ট্রেন চালাতে চায়, তাহলে বাংলাদেশকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
ব্যয়ের সমালোচনা ও জিওপলিটিক্যাল চাপ
বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। কিন্তু পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পে শুধু দুর্নীতি নয়, এর নেপথ্যে রয়েছে ভারত ও চীনের ভূরাজনৈতিক চাপ।
ভারতের স্বার্থ
ভারত দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তাদের সেভেন সিস্টারস রাজ্যগুলোর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে। টঙ্গী-ভৈরববাজার রুটে মিটার গেজে ডাবল লাইন তৈরি করার মাধ্যমে তারা তাদের প্রভাব বজায় রেখেছে।
চীনের কৌশল
অপরদিকে, চীন চেয়েছে বাংলাদেশে তাদের প্রভাব বজায় রাখতে। এজন্য তারা পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পকে সিঙ্গেল লাইনে সীমাবদ্ধ করেছে।
প্রকল্পটির নির্মাণ এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে ডাবল লাইনে রূপান্তর করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়। মাটি ভরাট করা অংশে লাইন বাড়ানো সম্ভব হলেও এলিভেটেড রেললাইন বা সেতুর ক্ষেত্রে নতুনভাবে নির্মাণ ছাড়া উপায় নেই।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
পদ্মা রেল লিংক প্রকল্প পুরোপুরি চালু হলে এটি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু সিঙ্গেল লাইনের সীমাবদ্ধতা এবং এর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
দেশের জন্য কী করণীয়?
- ডাবল লাইনে রূপান্তর: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পকে দ্রুত ডাবল লাইনে রূপান্তর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- সক্ষমতা বৃদ্ধি: সিঙ্গেল লাইনের সীমাবদ্ধতা দূর করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অবকাঠামো তৈরি করতে হবে।
- স্বচ্ছ নীতি: জিওপলিটিক্যাল চাপ এড়িয়ে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে রেলওয়ের উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে।
পদ্মা রেল লিংক প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হয়। তবে, সিঙ্গেল লাইনের সীমাবদ্ধতা, ভূরাজনৈতিক চাপ, এবং দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
একটি দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকর পরিকল্পনার মাধ্যমে এই সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করা সম্ভব। দেশের নীতিনির্ধারকদের উচিত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই অবকাঠামো নির্মাণে মনোযোগী হওয়া।
লেখক:
Fairuj Enan
উৎস: পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পের বাস্তবতা নিয়ে গবেষণা।
0 Comments