'উচ্চশিক্ষা বিসিএস আর আমরা'
বাংলাদেশে বেকারত্বের হার আসলে কত?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বূর্যো এর তথ্য অনুযায়ী ৪.২৯ শতাংশ (সরকারী প্রতিষ্ঠান ৩ আর ৪ এর ঘরের নামতা গুণবে এতে আর আশ্চর্য কি) হলেও, বিশ্ব ব্যাংক এর হিসাব মতে তা ১৪.২ শতাংশ। যেখানে আমেরিকার বেকারত্বের হার ৫ শতাংশের উপরে, সেখানে কর্তৃপক্ষ ৪.২৯ শতাংশ দেখিয়ে কি প্রমাণ করতে চায় কে জানে ! একটি দেশের মোট শ্রমশক্তির ১৪.২ শতাংশ কর্মহীন তা ভীতিকর কিন্তু তার চেয়েও ভীতিকর হলো, এই সংখ্যার একটা বড় অংশ উচ্চশিক্ষিত। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BIDS) এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের শিক্ষিত তরুণদের এক তৃতীয়াংশই বেকার । আমরা যদি কিছু ডেটা লক্ষ্য করি তাহলে এই অবস্থা যে কতটা গুরুতর তা অনুধাবন করতে পারবঃ
১. আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) এর তথ্য অনুযায়ী ২০০৬ সালে বাংলাদেশে শিক্ষিত(কমপক্ষে স্নাতক) বেকারের সংখ্যা ছিল ১.২৪ লাখ, ২০১০ সালে তা ৫৬ হাজারে নেমে আসলেও; এরপর শুরু হয় ভানুমতীর খেল। ২০১৩ সালে, মাত্র তিন বছরের মাথায় বেকারের সংখ্যা চার গুণ বেড়ে হয় ২.৪ লাখ। এর পরের চার বছরে প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৪.২ লাখে, ২০১৭ সালে । এখন যে এই সমীকরণ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা বোধহয় ইম্রুল ব্রোও জানেনা । তো এই ভানুমতীর খেলের রহস্যটা কী? তার, কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে পরের বহুল জনপ্রিয়, নন্দিত এবং নিন্দিত কিছু ডেটা দেখলে।
২. বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশন (BPSC) এর তথ্য অনুযায়ী, ৩২ তম বিসিএস এ ১৪৮৯ টি শূণ্য পদের বিপরীতে আবেদন পড়েছিল মাত্র ২৬৪৩৭ টি। প্রশ্ন উঠতে পারে ২৬৪৩৭ মাত্র হয় কিভাবে, তার উত্তর পাওয়া যাবে পরের ডেটা গুলো দেখলে। ৩৩ তম বিসিএস এ ৪২০৬ টি শূণ্য পদের বিপরীতে আবেদন পড়ে আগের বারের সাত গুণ বেশী প্রায় ২ লাখ। কারণ কি এত বিপুল উত্থানের? ২০১৩ ছিল ইলেকশনের বছর। সরকারী দলের প্রণয়নকৃত ইশতেহারে, তারা আবার নির্বাচিত হলে কর্মকর্তা কর্মচারীদের কেমন সুযোগ সুবিধা দিবে তার হা-বিতং বর্ণনা পড়ে এবং শুনেই প্রচুর তরূণ শাহবাগ এর আন্দোলন থেকে উঠে আবেদন করে ফেলেছিল। এরপরে ৩৭ তম বিসিএস পর্যন্ত আবেদনকারীর সংখ্যা দুই লাখের আশেপাশে উঠানামা করেছে, পদসংখ্যা ছিল যথাক্রমে, ২০৫২, ১৮০৩, ২১৮০, ১২২৬ টি। কিন্তু ৩৮ তম বিসিএস এ ২০২৪ টি শূন্য পদের বিপরীতে আবেদনকারীর সংখ্যা এক লাফে প্রায় চার লাখে পৌছে যায় (৩.৮৯ লাখ), কেন? অষ্টম পে স্কেলের মাধ্যমে সরকারী কর্মীদের বেতন ১০১% বাড়ানোর আদেশ কার্যকর করা এই উত্থানের বড় কারণ। এরপর আগের সব রেকর্ড ভেংগে দিয়ে ৪১ তম বিসিএস এ ২১৬৬ টি শূণ্য পদের বিপরীতে প্রায় পাঁচ লাখ আবেদনপত্র জমা পড়ে (৪.৭৫ লাখ) যার কারণ হিসেবে কাজ করেছে নবম বা এর উপরের গ্রেডে নিয়োগে কোটা প্রথা বাতিলকরণের আদেশ কার্যকর করা ।
৩. বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BIDS) এর তথ্য অনুযায়ী, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৩৮.৬ শতাংশ । ৬৬ শতাংশ তরুণ স্নাতোকোত্তর সম্পন্ন হবার ২-৩ বছর পরেও কর্মহীন আছেন । চাকরীর বয়স পেরিয়ে যাবার (৩০+) পরেও বেকার ৭ শতাংশ স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী। যারা বিভিন্ন চাকুরীরত আছেন তাদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ প্রাইভেট এবং ৩২ শতাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। কর্মরত স্নাতকদের মধ্যে ৬০ শতাংশ বেসরকারী সেক্টরে কাজ করছেন যাদের অধিকাংশই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন আর মাত্র ২.৭ শতাংশ সরকারী কাজ করছেন যাদের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।
৪. এখন, একটি মজার কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ডেটা দেখা যাক। যাদের বাবা-মা দুজনেরি স্নাতক ডিগ্রী আছে তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশেরও বেশী তরুন স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পন্ন করবার ৬ মাসের মধ্যে চাকুরী পেয়ে গিয়েছেন। অপরপক্ষে, যাদের বাবা-মা শিক্ষিত নয় তাদের মধ্যে চাকুরি পাবার হার কমে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে(২১.৯%)। এটা আবার বিপরীত ভাবেও সত্য। ৫৬ শতাংশ তরুণ বেকার যাদের মা-বাবা শিক্ষিত নয় এর অপর পিঠে এই হার মাত্র ২৭.৮ শতাংশ যাদের মা-বাবা শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও তারা বেকার।
৫. বিসিএস এর আবেদনকারীদের মধ্যে সিংহভাগ প্রার্থীই পড়াশোনা করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো থেকে। এবার, এনাদের ডেটায় চোখ বুলানো যাক। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর সবচেয়ে কম অবকাঠামোগত সুবিধা নিয়ে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক শিক্ষার্থীকে সেবা দেয়ার রেকর্ডের দাবীদার। বিশ্ব ব্যাংক (WB) এর তথ্য অনুযায়ী উপমহাদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই সবচেয়ে বেশী কলেজ (২৩০০ টি) রয়েছে যা দ্বিতীয় স্থানে থাকা নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের (১০৫৩ টি) চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশী। তৃতীয় ও চতূর্থ স্থানে আছে ভারতের মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় যথাক্রমে ৭৪৯ ও ৬১৪ টি কলেজ নিয়ে।
বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ২৩০০ টি কলেজে ১৮ লাখ ৭ হাজার ৩ শত ৫৯ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন মাত্র ৭৭ হাজার ৯ শত ৩৬ জন। প্রতি বছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৫ লাখ স্নাতক বের হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩ শতাংশ এইচ এস সি পরীক্ষায় জিপিএ ৫.০০ পেয়েছিল, ৪.০০ বা এর উপরে পেয়েছিল ২৯ শতাংশ, ৩.৫ বা এর উপরে পেয়েছিল ২৩ শতাংশ, ৩.০০ থেকে ৩.৫ এর মধ্যে পেয়েছিল ২৫ শতাংশ, ৩.০০ এর নিচে পেয়েছিল ১৯ শতাংশ। এতো গেল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাহ্যিক অবস্থা, এখন দেখা যাক চাকুরীর বাজারে তাদের পারফমেন্স কেমন।
৬. বিশ্ব ব্যাংক (WB) এর তথ্যমতে, স্নাতক পাশের তিন বছর পরেও বেকার থাকেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী এর বিপরীতে কাজে যোগদান করেন মাত্র ১১ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রীধারী। স্নাতকোত্তর পাশের পরেও কর্মহীন থাকে ৭১ শতাংশ। যারা পাশ করে কর্মরত আছেন তাদের মধ্যে ১৩ শতাংশ করছেন সরকারী চাকরী, ৫২ শতাংশ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারী সংস্থায়, ৪ শতাংশ বিভিন্ন প্রজেক্টে চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন। এই হিসাব কিন্তু সম্মিলিত হিসাব হয়, এটা শুধু যারা কাজ করছেন তাদের হিসাব। সম্মিলিতভাবে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট স্নাতক ডিগ্রীধারীদের মধ্যে ৯০ শতাংশেরই ইচ্ছা থাকে সরকারী চাকুরী লাভের কিন্তু, সরকারী চাকরী পায় মাত্র ১.৪৩ শতাংশ। হ্যা, এত বিপুল পরিমাণের মাত্র ১.৪৩ শতাংশ। আর ক্ষুদ্র ও মাঝারী চাকরী পায় মাত্র ৫.৭২ শতাংশ।
৭. পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাজ পাওয়া বা না পাওয়ার উপরেও তাদের বাবা-মায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রভাব রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯১ শতাংশের বাবা-মায়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মাধ্যমিক বা তার নিচে, এই ৯১ শতাংশের মধ্যে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থীই স্নাতক পাশের তিন বছরের মধ্যে কাজ পেয়েছে। বাকি ৯ শতাংশ এর বাবা-মা কমপক্ষে ডিপ্লোমা পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন, এই ৯ শতাংশ এর মধ্যে মোটামোটি অনেকেই কাজ পেলেও তার সংখ্যা খুবই সাধারণ, কোনমত সন্তোষজনক বলা যায়।
৮. এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক (ADB) এর তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর স্নাতক ডিগ্রীধারীদের প্রায় সবার প্রত্যাশিত স্যালারী ২৬০০০ টাকা বা এর আশেপাশে হলেও তাদের গড় প্রাপ্ত স্যালারি হলো ৯৪১১ টাকা, হ্যা ৯৪১১ টাকা যা তাদের প্রত্যাশার প্রায় তিন গুণ কম। মাত্র ১.২৭ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট তাদের প্রাপ্ত বেতন নিয়ে সন্তুষ্ট। এদের নিয়োগকর্তা যারা মূলত বিভিন্ন ক্ষুদ্র বা মাঝারী সংস্থা ও বিভিন্ন সরকারী দপ্তর তাদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৮১ শতাংশ ক্ষেত্রে এই গ্র্যাজুয়েটদের যোগ্যতা নয় শুধুমাত্র সনদ দেখে কাজে নেয়া হয়েছে।
৯. বাংলাদেশে ২০১৭ সালেও কর্মরত বিদেশী নাগরিক ছিল ৮৬০০০ জন যা ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে আড়াই লাখ, যারা প্রতিবছর ২৬০০০ কোটি টাকা দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে।
** গৃহীত সিদ্ধান্তঃঃ
১. ৩২ তম বিসিএস এর ২৬ হাজার আবেদনকারী সাতগুন বেড়ে ৩৩ তম তে গিয়ে যেমন প্রায় দুই লাখ হয়েছে তেমনি, ২০১০ এর শিক্ষিত(কমপক্ষে স্নাতক) বেকার সংখ্যা ৫৬৬০০ থেকে চারগুণ বেড়ে ২০১৩ তে প্রায় আড়াই লাখ হয়েছে। ২০১৭ তে বিসিএস এ আবেদনকারীর সংখ্যা যেমন বেড়ে আড়াই লাখ হয়েছে তেমনি বেকার সংখ্যাও বেড়ে ৪ লাখ পার হয়েছে। ৩৭ তম বিসিএস থেকে ৪১ তম বিসিএস এ দ্বিগুণ পরিমাণ আবেদনকারী বেড়ে প্রায় ৫ লাখ হয়ে গিয়েছে, বেকার শিক্ষিত(কমপক্ষে স্নাতক) এর পরিমাণ যে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে কে জানে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা মনে হয় ভয়ে আর জরিপ করছে না। তাহলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে, বাংলাদেশের শ্রম বাজার মনে হয় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে নাহলে চাকরির আবেদন সংখ্যা বাড়ে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেকার সংখ্যা কমে না গিয়ে উলটো বেড়ে যাচ্ছে কেন? বাংলাদেশে কি তাহলে চাকরি-বাকরী কিছু নেই? বাস্তবতা কিন্তু অন্য কথা বলছে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে, বিনিয়োগের ক্ষেত্র বেড়েছে, কাজ করার নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং সর্বোপরী অনেক নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। যার প্রমাণ হল বর্তমানে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের পরিমাণ যা গত তিন বছরে প্রায় ৩ গুণ বেড়ে ৮৬০০০ থেকে আড়াই লাখ হয়েছে। এরা প্রতি বছর দেশ থেকে তাদের বেতন হিসেবে ২৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, দেশের অর্থনীতি বড় হয়েছে দেশে কর্মক্ষেত্র বেড়েছে তাহলে বিদেশীদের কাজ বা চাকরী দেয়া হচ্ছে কেন? ভাইরে ভাই, আমরা স্নাতক পাশ করার ৪-৫ বছর পরেও টেবিলে বসে থেকে দিনে ১০-১২ ঘন্টা করে অরাকল আর এম্পিথ্রি পড়ব আর বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষা করবে আমাদের বয়স ৩০ বছর পার করে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাবার জন্য? এরপর এসে বলবে এসো বুড়ো বাবারা ২৬০০০ কোটি টাকা নিয়ে যাও?
২. কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থেকে রাষ্ট্রের সেবক হয়ে জনসেবা করার ইচ্ছা অব্যশই প্রশংসনীয়। কিন্তু এই ৪ লাখ ৭৫ হাজারের কতজনের মধ্যে তা আছে? বেশীরভাগের ইচ্ছাই ক্যাডার হয়ে বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করার জনসেবক হবার নয়। তার চেয়েও বড় কথা হলো যোগ্যতার, রাষ্ট্র যাদেরকে প্রান্তিক পর্যায়ে এক্সিকিউটিভ ক্ষমতা দিয়ে পাঠাবে, যারা একসময় দেশের নীতিনির্ধারক হবে, যারা অন্য দেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে, যারা ভবিষ্যতের গবেষক,আমলা,ডাক্তার,প্রকৌশলী তৈরী করবে তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া কি এতই সহজ? শুধু দিনে ১০-১২ ঘন্টা পড়লেই কি এর সমতূল্য হওয়া যায়? অব্যশই না।প্রত্যেক কাজেরই নির্দিষ্ট কিছু স্কিলসেট থাকে। লজিক লেভেল পাঁচ বছরের বাচ্চার সমতূল্য হতে চায় কূটনীতিবীদ, দশ জনের সামনে মুখ খুলতে ভয় পায় হতে চায় আমলা, রাতে ভয়ে বের হয় না হতে চায় অপরাধদমনকারী তাহলে কি হবে? যে, যে কাজের জন্যে যোগ্য সেটা আগে বের করতে হবে। তারপর, সেই কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় স্কিলসেট জোগাড়ের চেষ্টা করতে হবে । না, আয়মান ভাইয়ার পাওয়ার পয়েন্ট স্কিল না, রিয়েল লাইফ স্কিল। বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধান করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। নির্দিষ্ট কাজের জন্যে উপযুক্ত স্কিলসেট না থাকলে দিনে ১০ ১২ কেন ২৪ ঘন্টা পড়েও লাভ হবে না। তাহলে এত সংখ্যক তরুণ পংগপালের মত এর পেছনে ছুটে নিজের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট করছে কেন? এর ব্যাখ্যা আমি পরের পয়েন্টে দেব। এখন ছবিতে যে গ্রাফ আছে তা যদি দেখি, সেখানে যে লাল লাইন যেটা পাতাল প্রায় স্পর্শ করে ফেলেছে সেটা হলো বিসিএস দিয়ে চাকুরী পাবার সম্ভাবনা আর সবুজ লাইন যেটা প্রায় মহাকাশ পর্যন্ত পৌছে গেছে এটা হচ্ছে বিসিএস এ আবেদনকারীর সংখ্যা; সামনের বছর হয়ত এই লাইন মহাকাশ পার হয়ে অন্য ব্রহ্মান্ডে পৌছে যাবে। এই যে দুই লাইনের মধ্যের এভারেস্ট সমান গ্যাপ, মাত্র ০.০০৪ ও ০.০০৫ শতাংশ সম্ভাবনা চাকরির তাও তরুণেরা কেন তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ ও কর্মক্ষম সময়গুলো এভাবে নষ্ট করছেন?
৩. আগের পয়েন্টের উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর এখানে দেয়া হবে। পারতপক্ষে মা-বাবার শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে ছেলেমেয়ের চাকুরী পাবার কোন যোগসূত্র না থাকলেও, পুর্বেই আমরা দেখেছি যাদের মা-বাবা স্নাতক তাদের কাজ পাবার সম্ভাবনা ও দ্রুততা অন্যান্য দের তুলনায় বেশী। আমরা জানি বিসিএস আবেদনকারীদের মধ্যে সিংহ ভাগ জাতীয় এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষার্থী। আমরা এও দেখেছি এই সব ক্ষেত্রে ৯ শতাংশের মা-বাবা ডিপ্লোমা/স্নাতক বা এর উপরের ডিগ্রীধারী। বাকি ৯১ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক/প্রাইমারী বা এর নিচে। স্বভাতই এই অভিভাবদের বাংলাদেশের বর্তমান শ্রমবাজার বা কর্মক্ষেত্র নিয়ে খুব বেশী ধারণা নেই। তারা, তথাকথিত সমাজের কথা শুনে, বেতন স্কেল, ক্ষমতা দেখে নিজেদের সন্তানদের ওপর বোঝা চাপিয়ে দেন তোমাকে ক্যাডার হতেই হবে, যার কারণে সন্তানরাও কাথা কম্বল নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন এবং দেশের বিশাল এক অপরিসীম ক্ষমতাশালী অংশ অকেজো হয়ে যায়। আরেকটি কারণ হলো, বর্তমান এবং নিকট ভবিষ্যতের শ্রমবাজার এবং কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকা। বেশীরভাগ স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীই জানেনা তারা যে বিষয়টি পড়ছে সেটা পড়ে তারা কি করবে বা দেশে বা বিদেশে সেই বিষয়কেন্দ্রিক কোন কোন কাজ হয়। তারা যা পড়ছে সেটি ব্যবহারিক জীবনে কিভাবে অবদান রাখে সেটিও জানার চেষ্টা করেনা এর ফলে, তাদের অর্জিত জ্ঞান এবং তার প্রয়োগের মধ্যে একটা দেয়াল তৈরী হয়ে যায়। প্রস্তর যুগের সিলেবাস এবং পঠনপদ্ধতিও এ জন্যে অনেকাংশে দায়ী, স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা যেহেতু কর্ম কেন্দ্রিক তাই সিলেবাস ও যুগোপযোগি এবং কর্মক্ষেত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন হওয়া উচিত। তবে সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা তৈরী করা প্রয়োজন তা হলো, নিজেকে সঠিকভাবে ইভ্যালুয়েট করতে পারার ক্ষমতা। বোর্ড পরীক্ষাগুলোতে ভূরি ভূরি এ প্লাসের ছড়াছড়ি, নিজেকে সঠিকভাবে মূল্যায়নের অভাব ইত্যাদির কারণে আমরা বেশীরভাগ সময় নিজেদের অভার এস্টীমেট করি বা আন্ডার এস্টীমেট করি যার ফলে নিজেদের যোগ্যতার চেয়ে উচু পদের পিছনে ছুটতে গিয়ে তা পাইনা ফলে অসন্তুষ্ট থাকি আবার যোগ্যতার চেয়ে নিচু কোন পদে চাকরি করে অসন্তুষ্ট থাকি, কোনভাবেই ব্যাটে বলে হয় না। যা প্রমাণ হয়, গ্র্যাজুয়েটদের মাত্র ১.৩ শতাংশ তাদের নিজেদের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট ৯৮ শতাংশেরও বেশি নিজেদের অবস্থান নিয়ে অসন্তুষ্ট এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) এর দেয়া এই ডেটা থেকে। এছাড়াও আরো অনেক কারণ রয়েছে তরূনদের এই ৩-৪ বছর কর্মহীন থেকে মরীচিকার পেছনে ছোটার পেছনে।
৪. বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান(BIDS) এর এক জরিপে, চাকরীদাতাদের মধ্যে ৯৩ শতাংশ বলেছেন, তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের বেশী অগ্রাধিকার দেন এই বিশ্বাসে যে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা চাকুরির জন্যে অধিক প্রস্তুত। ৭৭.৬৩ শতাংশ এমপ্লয়াররা মনে করেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের অনেক ঘাটতি আছে। এটাই কি স্বাভাবিক নয়? প্রস্তর যুগের সিলেবাস পড়ে, নিজ উদ্যোগে নিজ কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে ধারণা এবং অর্জিত জ্ঞানের সাথে তা তুলনা না করলে কিভাবে তারা শ্রমবাজারে নিজের মূল্য তৈরী করবে? তার উপর মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে আছে বিসিএস। স্নাতক সম্পন্ন হবার দুই তিন বছর পরেও তারা এককেন্দ্রিক থাকে ফলে শেষ মেশ বেকার থাকা বা নিজের যোগ্যতার নিচের কোন পদে থেকে অসন্তুষ্ট হওয়া।এজন্যে স্নাতক পর্যায়ের প্রথম থেকেই নিজের বিষয় সম্পর্কিত স্বচ্ছ ধারণা এবং সেই বিষয়ের সাথে শ্রমবাজারের সম্পৃক্ততা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে একাডেমিক জ্ঞান কিভাবে কাজে লাগে তার ধারণা রাখতে হবে।
৫. বাংলাদেশে শুধুমাত্র জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ২৩০০ কলেজ থেকেই প্রতিবছর ৫ লাখ স্নাতক পাশ করে বের হয়। আমরা যে আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার হার নিয়ে এত গর্ব করি তা মূলত এদের জন্যেই। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এত সংখ্যক গ্র্যাজুয়েটদের খুব কম সংখ্যকই কর্মজীবনে সুবিধা করতে পারছে। স্নাতক পাশের ৩-৪ বছর পরেও ৮০ শতাংশকে থাকতে হচ্ছে বেকার। তবে, এইযে প্রতিবছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ থেকে লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট হয়ে বের হচ্ছে এর কতজন আসলেই স্নাতক হবার যোগ্য? ব্যাঙের ছাতার মত অলিতে গলিতে গজিয়ে ওঠা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবার পর “আমি স্নাতক” মনোভাব যে দেশের অর্থনীতিতে কতটা খারাপ প্রভাব ফেলছে তা বিদেশিকের বেতনের ২৬০০০ কোটি টাকা গুণলেই বোঝা যায়। যেখানে বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই প্রকৃতপক্ষে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই “বিশ্ববিদ্যালয়” হয়ে উঠতে পারেনি এখনো সেখানে এদের অধিভুক্ত কলেজ গুলোর অবকাঠামো বা শিক্ষাব্যবস্থা কি অবস্থায় আছে তা ভাবাও যায় না। এই অবস্থা দূর করার কোন উপায় ও আপাতত নেই । তবে আসন্ন দিন গুলোতে এমন অবস্থা আরো বেশী গুরুতর হয়ে দেশকে কোমায় যাতে না পৌছে দেয় সেই ব্যবস্থা করা অতীব জরুরী।
সবশেষে, করোনা বাংলাদেশে ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে এখনো এবং নির্মুল হবার পর অর্থনীতিতেও। গোটা পৃথিবীতেই করোনা বড় ধরণের অর্থনৈতিক পরিবর্তন আনতে চলেছে। চতূর্থ শিল্প বিপ্লবকে আরো বেগবান করেছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অটোমেশন প্রাক্কলিত ধারণার আরো আগেই চলে আসবে, সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেয়া হবে, আরো বহু ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে। করোনায় ত্রিশ চল্লিশ লাখ মানুষ মারা গেলে যতটা ক্ষতি হবে তার চেয়েও বড় ক্ষতি করবে জনগণ এবং সরকারের ইনকম্পিটেন্সি। আশা করা যায়, নতুন প্রজন্ম প্রস্তরযুগীয় প্রচলিত সব ধ্যান ধারণাকে বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে, প্রাণোধিক প্রিয় বাংলাদেশকে উদ্ধারের কোন না কোন উপায় বের করে ফেলবে। আমাদের পূর্বসুরীরা তো পারল না, স্টেরিওটাইপিক ধ্যান ধারণার মাকড়সার জালে আটকে থাকলো
সারাজীবন।
গবেষণা এবং রচনা করেছেন আসিফ খান উল্লাস,
ছাত্র, পরিসংখ্যান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় .
![]() |


0 Comments